২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তবে শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগসহ বিএনপি বিরোধীদলগুলোর আপত্তির কারণে শুরু হয় নানা বিতর্ক। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকলে সরকারের চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। নিয়োগ দেয়া হয় নতুন উপদেষ্টা। এরই মধ্যে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়।
এর মধ্যে নানা কারণে-অকারণে তৎকালীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে এক চরম রাজনৈতিক সংঘাত, অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার মধ্যে এক রাতে আকস্মিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। জারি করা হয় সান্ধ্য আইন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীনকে। এসময়ই মূলত রক্ষক যখন ধর্ষক এর মত বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উপর উপর্যপুরি ধর্ষণে মৃত্যুঘটে স্বাধীন বাংলার মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ভোট নামক মৌলিক অধিকারের উপর। এর জ্বলজ্বলন্ত প্রমান: ভারতের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার দি কোয়ালিশন ইয়ার্স, ১৯৯৬-২০১২ গ্রন্থে।
এটি তার দ্বাদশ গ্রন্থ, তার সক্রিয় রাজনীতির শেষ ১৬ বছরের অভিজ্ঞতার কাহিনী তুলে ধরেছেন। এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার সময় তথা ২০১২ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে। তিনি ৪৩ বছর ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি এমপি, লোকসভা ও রাজ্যসভার নেতা, পরিকল্পনা কমিশনের উপ-প্রধান, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গান্ধী মনমোহন সিংকে নির্বাচন করায় তার আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত অনেক সময় খুবই উন্নাসিক ও উদ্ধত্যপূর্ণ ধারণা পোষণ করে। আর ভারত যে উপনিবেশ-পরবর্তী বিশ্বে নিজেকে শ্রেষ্ঠ, নব্য-উপনিবেশ শক্তি মনে করে সেটাই অবচেতনভাবে প্রণব বাবু নতুন করে নিশ্চিত করলেন।
তাছাড়া শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্য এবং বাংলাদেশের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রণব মুখার্জির খোলামেলা বক্তব্য সাধারণভাবে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষজনের কাছে খুবই অস্বস্তিকর। অবশ্য যারা চায় বাংলাদেশ, ভারতের অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকুক, তারা বাংলাদেশের ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার হস্তক্ষেপের জন্য চিরকৃতজ্ঞ হয়েই থাকবে।
আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি এমন একটি ঘটনার কথা বলেছেন, যা কার্যত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপই। মুখার্জি লিখেছেন: ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে (তিনি তখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বাংলাদেশের সেনাপ্রধান মঈন-ইউ আহমেদ ছয় দিনের সফরে ভারত এলেন। তিনি আমার সাথেও স্বাক্ষাৎ করলেন। অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় আমি তাকে রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার গুরুত্ব বোঝালাম।
তারপর প্রণব উল্লেখ করেছেন, হাসিনা সরকারের আমলে জেনারেলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে তার উদ্বেগও দূর করলেন এই বলে: ‘আমি ব্যক্তিগত দায়দায়িত্ব গ্রহণ করলাম, জেনারেলকে হাসিনার ক্ষমতায় ফেরার পরও তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার আশ্বাস দিলাম। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়নকে দিয়ে আমার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সব রাজবন্দির মুক্তি এবং দেশটির স্থিতিশীলতা প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করলাম।’ বাংলাদেশের সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে ভারতের সম্পৃক্ততা অব্যাহত থাকার বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেছেন।
আত্মজীবনটিতে আরো বড় ধরনের গোপন তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা আশ্বাস দেন, মঈনই থাকবেন সেনা প্রধানের দায়িত্বে। এছাড়া হাসিনার দুঃসময়ে তাকে ত্যাগকারী আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রণব তিরস্কার করেছিলেন বলেও তিনি তার বইতে উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরও বলেছেন: ‘হাসিনা যখন জেলে ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা তাকে ত্যাগ করে। আমি তাদেরকে ধমক দিয়ে বলেছিলাম, খারাপ সময়ে কাউকে ছেড়ে যাওয়া অনৈতিক কাজ।’ এত খোলামেলা আর সততার জন্য প্রণব ধন্যবাদও পেতে পারেন! তবে তিনি জানাচ্ছেন, তিনি নিজে ভারতীয় রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন, ভারতীয় স্বার্থের দিকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে পরিচালিত করতেন।
এছাড়া ভারত যে সবসময়ই বড় ভাইসুলভ অনধিকারচর্চা করে থাকে, দেশটি বাংলাদেশের জন্য এক মারাত্মক প্রতিবেশী। তার প্রমান প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক মুখ্যসচিব ড. কামাল সিদ্দিকী একটি ব্যক্তিগত পত্রে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের শীর্ষপর্যায়ের কিছু নেতার কর্তৃত্বপরায়ণতার বিষয়টি বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই লেখককে তিনি পত্রটি লিখেছিলেন ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর। তিনি ২০০৬ সালে নয়া দিল্লিতে শীর্ষ পর্যায়ের একটি বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে কী ধরনের আচরণ করেছিলেন, তার প্রত্যক্ষ অকপট বর্ণনা দিয়েছেন:
“এটি ছিল ২০০৬ সালের মার্চে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক। আমাদের পক্ষে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্শেদ খান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান, মুখ্যসচিব হিসেবে আমি, পররাষ্ট্রসচিব শমশের মুবিন চৌধুরী। বৈঠক শুরু হওয়ামাত্র আমি দেখলাম, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সীমা ভয়াবহ মাত্রায় অতিক্রম করে ভারতের সাথে ‘খারাপ ব্যবহার’ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে কামান দাগছেন। আমরা উলফাকে সমর্থন করছি বলেও অভিযোগ করলেন। অভিযোগটা ছিল ডাহা মিথ্যা। তিনি কথা বলার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিকে অত্যন্ত অমার্জিত ভঙ্গিতে আঙুল তুলছিলেন। বোঝা গেল তিনি ভদ্রলোক নন। তার ব্যবহৃত ভাষা ছিল পশ্চিমবঙ্গের কেরানিদের ব্যবহার করা বাবু ইংরেজি।”
কামাল সিদ্দিকীর ভাষ্যে বাবু প্রণব মুখার্জির পরিচয় জানা যায়। তিনি একসময় ছিলেন উচ্চমান কেরানি। তিনি সাম্প্রতিক অতীতে তার কৌশল এবং বাংলাদেশী রাজনীতিবিদদের অবমূল্যায়ন করা নিয়ে লিখেছেন। ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন কাজ তিনি একমাত্র লোক হিসেবে করেছেন, এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি অনেক সময় সিনিয়র ভারতীয় সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তারা পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর নেতাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাধর দেখা যায়।
আমরা ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের কথা জানি। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন স্রেফ সরকারি কর্মচারী। তিনি পর্যন্ত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তথাকথিত পার্লামেন্টারি নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন।
তিনি ঢাকা এসেছিলেন আক্ষরিকভাবেই এরশাদকে চাপ দিয়ে বশে আনার জন্য। ঢাকায় সুজাতা সিংয়ের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পূর্ব পর্যন্ত তিনি হাস্যকর নির্বাচনটিতে অংশ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। বৈঠকের পর তিনি তার মন পরিবর্তন করেন। তিনি ভোটারবিহীন নির্বাচনে অংশ নেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হন। ভারতের ইচ্ছানুযায়ী এরশাদ আরও পাঁচ বছরের জন্য হাসিনাকে ক্ষমতায় থাকার বৈধতা দিয়েছিলেন।
উপরের ভাষ্য অনুযায়ী, ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা সাধারণভাবে এবং বিশেষ করে কংগ্রেসর রাজনীতিবিদেরা তাদের নিজস্ব লোকদের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন করার জন্য করার কোনো কিছুই বাদ রাখেননি। তাদের সবচেয়ে পছন্দের বাংলাদেশী রাজনীতিবিদদের বেশির ভাগই আছেন আওয়ামী লীগ এবং জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত জাতীয় পার্টিতে।
সম্ভবত মোরারজি দেশাই, ভি পি সিং, আই কে গুজরালকে বাদ দিলে ১৯৭১ সালের পর অধিকাংশ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীই বাংলাদেশের ব্যাপারে ছিলেন অনধিকারচর্চামূলক ও আধিপত্যবাদী। প্রণব মুখার্জির সর্বশেষ গ্রন্থ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশের সফররত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে তার অসৌজন্যমূলক আচরণ থেকে যেটুকু পাচ্ছি তা আসলে ‘ভারতের বাংলাদেশ নীতি’র দৃশ্যমান অতি সামান্য অংশবিশেষ। ভারত আসলে বাংলাদেশের সাথে তার ওপর নির্ভরশীল দেশের মতো আচরণ করে, সার্বভৌমত্ত্ব দেশ হিসেবে বিবেচনা করে না।
অতএব, এখন নরেন্দ্র মোদি, সুষমা স্বরাজ এবং মোদি সরকারের অন্য সদস্যদের কোনো ধরনের ইচ্ছা নেই বা তাদের কোনো হস্তক্ষেপমূলক নীতি নেই, এমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
এছাড়া বাংলাদেশ সফরের সময় সুষমা স্বরাজ কী করেছেন দেখুন। তিনি তথাকথিত বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের সাথে সাক্ষাত করেননি। এর বদলে তিনি খালেদা জিয়ার (হাসিনার অপছন্দ সত্ত্বেও) সাথে সাক্ষাত করেছিলেন।
এর কারণ কি? নয়া দিল্লির অগোপন বাংলাদেশ বিরোধী অ্যাজেন্ডা যা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়।
ভারতের বাংলাদেশ নীতি প্রসঙ্গে মনমোহনের চেয়ে মোদিকে অনেক ভালো বিকল্প বিবেচনা করা এবং প্রণব মুখার্জির চেয়ে সুষমাকে ভালো মানুষ বিবেচনা করার চেয়ে হিতে বিপরীত যা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে "গণতন্ত্রের জন্য অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদীয় নির্বাচন ভালো নয়"- এমন উপদেশ বাংলাদেশকে দিয়েই বসলো সুষমা স্বরাজ !
তাছাড়া, স্বাধীন বাংলাদেশে ৭৫ এ শেখ মুজিব হত্যার পর ভারতের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশকরে যে শেখ মুজিব হত্যা মূলত ভারতের ইন্দনেই হয়েছে। এ যুক্তির মীমাংসায় যাবার আগে ভারতের খ্যাতিমান ও প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের অতি সাম্প্রতিক একটি মন্তব্যের দিকে পাঠকের দৃষ্টি ফেরাতে চাই। ভারতের ‘দ্য ট্রিবিউন' পত্রিকায় প্রকাশিত [২৫-০৮-১০] এক নিবন্ধে কুলদীপ নায়ার শেখ মুজিবের হত্যাকান্ড ঠেকাতে ভারতের ব্যর্থতার সমালোচনা করেছেন। ‘‘ভারতের স্বাধীনতা দিবসের একইদিনে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের ঘটনা ভারতের জনগণ কোনদিন ভুলতে পারবে না’’ বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষে এই অনুতাপ চিরদিন আমাদের থেকে যাবে। কারণ, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অাঁচ করতে পেরেছিল, শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান ঘটবে। কিন্তু শেখ সাহেবের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে, ঢাকাকে এটুকু অবহিত করা ছাড়া এ ঘটনা ঠেকাতে আমরা কিছুই করিনি।’’ প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত ও তার সমর্থক অনুগামীরা যদি দৃঢ়ভাবে এটা বিশ্বাস করেন যে, একাত্তরের পরাজিত শত্রু, তথা পাক-মার্কিন অক্ষ মুজিব হত্যার নাটের গুরু, তাহলে ভারতের নিষ্ক্রিয়তার সমীকরণ তারা কিভাবে টানবেন? ভারতের এই ‘কিছুই না করার' ব্যর্থতা কী নিছক অমনোযোগিতা না দুর্ঘটনা? নাকি মুজিব হত্যার রচিত দৃশ্যপট বাস্তবায়ন কামনা করে ভারত তাকে পরোক্ষ সমর্থনে সফল করে তুলেছিলো?
ঢাকায় ১৫ আগস্ট যে অভ্যুত্থান ও বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটেছে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র'-এর অজ্ঞাতসারে তা ঘটেছে বলে কেউ বিশ্বাস করেন না। এ প্রশ্নে যাবার আগে মুজিব হত্যার পর ভারতের খ্যাতিমান সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় পশ্চিম বাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়সহ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যকার আলাপচারিতার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। অবশ্যই সেটা মুজিব হত্যার ঘটনাকেন্দ্রিক।
অন্নদা শংকর লিখেছেন : ‘‘আমি কাঁদতে কাঁদতে একটা প্রবন্ধ লিখি। নাম রাখি- ‘‘কাঁদো, প্রিয় দেশ।’’ সেটি পাঠিয়ে দেই ‘দেশ' পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে। সাগরময় ঘোষ সেটি ফেরত দিয়ে লিখেন : ‘‘ছাপাতে পারা যাবে না মুখ্যমন্ত্রীর বারণ।’’ মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সাথে অন্নদা বাবু দেখা করে এর বৃত্তান্ত জানতে চাইলে তিনি তাঁকে বলেন : ‘‘ঢাকায় যা ঘটেছে, তা আরও ভয়ানক। শোনা যাচ্ছে, চার হাজার লোক মারা গেছে। এমন অবস্থায় এই প্রবন্ধ প্রকাশ না করাই ভালো। এই প্রবন্ধ প্রকাশে হয়তো এক কোটি লোক এপারে এসে শরণার্থী হবে। আমরা মারা যাবো। ’’ অনেক পীড়াপীড়ির পর মুখ্যমন্ত্রী লেখাটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর মতামতের জন্যে সেটি অনুবাদ করে দিল্লী পাঠান। অন্নদা বাবু লিখেছেন : ‘‘কিছুদিন পর পেলুম শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর লেখা এক চিঠি।
তাঁর মতে, আমার প্রবন্ধ প্রকাশ করা হলে ভারত সরকার হবে বিব্রত। সুতরাং ওটি প্রকাশ না করাই উচিত। তাঁরই তো শোক প্রকাশ করা উচিত। তাঁর সরকারেরতো উচিত জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা। তাঁরইতো উচিত সরকারিভাবে শোক প্রকাশ করা। কয়েকমাস পরে আমি আবার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রবন্ধটি প্রকাশের অনুমতি চেয়ে চিঠি দেই। তিনি নিরুত্তর। আবার কয়েকমাস পরে চিঠি লিখি। তিনি নিরুত্তর। আবার কয়েকমাস পরে চিঠি লিখি। তিনি নিরুত্তর। আবার কয়েকমাস পরে চিঠি লিখি। তিনি নিরুত্তর।
তখন নিতাই মজুমদার নামে একজন নতুন প্রকাশক প্রস্তাব করেন যে, তিনি আমার প্রবন্ধটি আরও কয়েকটি প্রবন্ধের সাথে মিলিয়ে বই করে প্রকাশ করতে চান। বইয়ের ওপর সেন্সরশিপ নেই। ‘কাঁদো প্রিয় দেশ'-নামে বই হয়ে বের হয়। ভারতীয় নাগরিক অন্নদা বাবুর মনে যে প্রশ্নের দহন, বঙ্গবন্ধুভক্তদের মনে এমন প্রশ্ন নেই কেন?
আরও প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশ বিরোধী প্রকাশনাকে বরাবর উৎসাহ দিয়ে প্রকাশ করে, সেখানে মোশতাক সরকারের সময় ভারত সরকার কেন এই সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল?
এবার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকেনা যে, ভারত শুরু থেকেই বন্ধু হয়ে বাংলার জনগণের ভাষা না বুঝে বরং ১/১১ এ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করে গণতন্ত্রের স্বাধীনতার নামে মৃত্যুর আয়োজন করেছিলো।
No comments:
Post a Comment